একমাত্র বাঙ্গালী রাষ্ট্রপতি তথা বাংলার গর্ভ প্রণব মুখার্জীর প্রয়াণে শোকাহত গোটা দেশ... তাঁর স্মৃতি মন্থনে সার্বভৌম সমাচার পত্রিকার জন্য কলম ধরলেন বনগাঁ শহর কংগ্রেসের প্রাক্তণ সভাপতি কৃষ্ণপদ চন্দ
...প্রণব বাবু বনগাঁতে
ব্যক্তিগত পর্যায়ে খুব বেশী এসেছেন বলে জানা নেই, তবে ১৯৮২ সালে গোপালনগরে ভূপেন
শেঠের ভোটের জনসভা করতে এসেছিলেন। কলকাতা কপার হাউস থেকে
বনগাঁর ছাত্র নেতা, পরবর্তীতে যুব কংগ্রেসের সহ-সভাপতি আমার বন্ধু দেবু চ্যাটার্জী
সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন, যাওয়ার সময়ে প্রণব বাবুর গাড়ীতে
উঠে তাঁকে কলকাতার দিকে এগিয়ে দিতে গেছিলেন। সেই দিন ভূপেনদার সাথে
প্রণব বাবুর প্রথম সঠিক অর্থে পরিচিতি ঘটে...
গত ৩১ আগস্ট ২০২০ দেশের একমাত্র
প্রাক্তন বাঙ্গালী রাষ্ট্রপতি রাজনৈতিক চাণক্য হিসাবে আখ্যায়িত আমাদের
রাজ্যের গর্ব ভারতরত্ন প্রণব মুখার্জীর প্রয়াণে তাঁর সম্পর্কিত কিছু
লেখার জন্য আমাকে “সার্বভৌম সমাচার”-এর পক্ষ থেকে জানানো হয়। আমার জানা মতে তাঁর সম্পর্কে কিছু
লেখার চেষ্টা করলাম।
প্রণববাবুর জীবনকাল
১৯৩৫ সাল থেকে শুরু করে ৩১শে আগষ্ট ২০২০ অবধি। সমস্ত সময়কালটাই
বর্ণময় হিসাবে পরিগণিত হয়েছে দেশের মানুষের কাছে। বীরভূম জেলার কীর্নাহারের মিরিটি
গ্রামে জন্ম গ্রহণ করার পরে পড়াশোনা সমাপ্ত করে, কিছুদিন ডাক ও তার বিভাগে করণিকের
চাকরি, পরে স্কুল ও কলেজে শিক্ষকতা সহ সংসার জীবনে বিবাহ, সন্তান প্রতিপালন ইত্যাদি
করার মধ্যেই ১৯৬৬ সালে রাজ্যের প্রয়াত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখার্জীর
ভাবধারাতে উৎসাহিত হয়ে “বাংলা কংগ্রেস” দলের হয়ে রাজনীতির আঙ্গিনায় প্রবেশ।
ঐ বছরেই “বাংলা কংগ্রেস” দলকে কংগ্রেস দলের মধ্যে একাত্ব করার ফলে প্রনব বাবু এই
রাজ্য থেকে রাজ্যসভার সাংসদ হিসাবে মনোনীত হয়ে ক্ষমতার আঙ্গিনায় প্রবেশ করেন এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী
ইন্দিরাগান্ধীর নজরে পড়ার পর থেকে রাষ্ট্রপতির দায়িত্বে ২৫শে জুলাই ২০১৭ অবধি দীর্ঘ ৫১ বছর
ক্ষমতার অলিন্দে অবাধ বিচরণ করেছেন এবং সুনামের সাথেই বিভিন্ন দায়িত্ব পালন
করেছেন।
একমাত্র অধরা থেকেছে দেশের প্রধানমন্ত্রী পদ অলংকৃত করা। শোনা যায়, তারও একটা কারন ছিল। সেটা দেশের প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় ইন্দিরা গান্ধী ১৯৮৪ সালে ৩১শে অক্টোবর নিজের দেহরক্ষীদের গুলিতে শহীদ হওয়ার দিনে তার পুত্র রাজীব গান্ধী, যিনি কিছু দিন আগে নিজের বিমান চালকের চাকরি থেকে অবসর নিয়ে পূর্ণ সময়ের জন্য রাজনীতিতে প্রবেশ করেন এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস দলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়ে ঐদিন পশিচমবঙ্গ সফরে ছিলেন এবং সফরের মাঝ পথেই তাঁর মায়ের মৃত্যুর খবর পেয়ে সফর বাতিল করে দিল্লী ফেরেন। ঐ সফরে রাজীব গান্ধীর সাথে প্রণববাবু আর গণি খান চৌধুরী (দুজনেই ইন্দিরা গান্ধী মন্ত্রীসভার গুরুত্বপূর্ণ সিনিয়ার মন্ত্রী) সঙ্গি হিসাবে ছিলেন। সেই দিন সেই ঘটনাতে দেশের যে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল, তার জন্য দেশে একজন অন্তবর্তী প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ একান্ত আবশ্যক হয়ে পড়েছিল। ফেরার বিমানে রাজীব গান্ধীর সাথে প্রণববাবু আর গণি খান চৌধুরী একসাথেই দিল্লী যাচ্ছিলেন। শোনা যায়, সেই যাত্রাকালীন সময়ে প্রণববাবু আর গণি খান চৌধুরী মধ্যে কিছুটা মতান্তর সৃষ্টি হয়েছিল, দুজ’নেই অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নিজেকে উপস্থাপন করার জন্য উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় করেন। সমগ্র বিষয়টি রাজীব গান্ধীর উপস্থিতিতেই ঘটে এবং সেই মুহুর্তেই ঘটনাটি দিল্লীতে সকলেই জেনে যান। বিমান পৌঁছানোর আগেই কংগ্রেস দলের তৎপরতায় রাষ্ট্রপতি সর্দার জ্ঞানী জৈল সিং রাজীব গান্ধীকে বিমানবন্দর থেকে রাষ্ট্রপতি ভবনে ডাকেন এবং প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ বাক্য পাঠ করিয়ে দেশের দায়িত্ব অর্পণ করেন। রাজীব গান্ধী তারপরে তাঁর মায়ের মৃতদেহ দেখতে যান। অর্থাৎ রাজীব গান্ধী পুত্র হিসাবে মায়ের মৃত দেহকে সন্মান জানাতে যান, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী হিসাবে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীকে সন্মান জানাতে পেরেছিলেন।
রাজ্যসভায় এর পরেও আরো চারবার তিনি মনোনীত সাংসদ হন। ১৯৭৩ সালে ইন্দিরা গান্ধী মন্ত্রীসভায় শিল্পোন্নয়ন দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী হিসাবে সু্যোগ পান। এর পরে বিভিন্ন দপ্তরের দায়িত্ব পালন করে ১৯৮২ সালে দেশের অর্থমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পান। ১৯৮৪ সালে ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যু এবং পূর্বে উল্লেখিত ঘটনার ফলে রাজীব গান্ধী মন্ত্রী সভায় মন্ত্রী তালিকা প্রস্তুত করার পরেও মন্ত্রীসভাতে তাঁর ও গণি খান চৌধুরীর স্থান হয়নি।
কিছু মতান্তর এবং নিজেকে
অসন্মানিত মনে করে ১৮৮৪ সালে নিজে নতুন দল “রাস্ট্রীয় সমাজবাদী কংগ্রেস” তৈরী
করেন। আমাদের জেলাতে তার প্রধান সেনাপতি হিসাবে জেলার প্রয়াত মন্ত্রী তথা
“যুগান্তর” ও ইংরাজী দৈনিক ‘অমৃতবাজার পত্রিকার’ মালিক হাবড়া থেকে নির্বাচনে দলের
প্রাথী হওয়া তরুণ কান্তি ঘোষের সর্বক্ষনের সাথী বিখ্যাত তিন জন- কান্তি
চ্যাটার্জী, শ্যামল চ্যাটার্জী ও ভগীরথ চ্যাটার্জীর অন্যতম শ্যামল চ্যাটার্জী, এই
জেলাতে প্রণব বাবুর প্রধান সেনাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করতেন। সেই সময় প্রণববাবু একবার
বনগাঁ টাউন হল ও ললিত মোহন বাণী ভবনে সভা করতে এসেছিলেন।
এখানকার দায়িত্বে ছিলেন নীলরতন বিশ্বাস, প্রাক্তন পৌরপতি প্রয়াত শিবপ্রসাদ সরকারের
ভাগনে চন্দন দত্ত ও ছাত্রনেতা গাড়াপোতার
কালীপদ বিশ্বাস (পরে খুন হন)। লোক জমায়েত বেশী হয় নি। আমিও ঐ সভা
দেখতে গেছিলাম নারায়ন মিত্র, প্রয়াত ভূপতি রায় এদের সাথে। ঐ দিন তিনি দুপুরে বনগাঁ
ডাক বাংলোতে উঠেছিলেন।
তাঁর নতুন দল এই
রাজ্য বা দেশের অন্য রাজ্যে খুব একটা দাগ কাটতে না পারায়
১৯৮৯ সালে তাঁকে কংগ্রেস দলে মিশতে বাধ্য
হতে হয়।
১৯৯১ সালে রাজীব গান্ধীর মৃত্যুর পরে
নরসিমা রাও এর মন্ত্রী সভায় প্রথমে তাকে জায়গা না দিয়ে যোজনা কমিশনের ডেপুটি
চেয়ারপার্সন করা হয় এবং তার ক্ষমতার অলিন্দে পুর্নউত্থান শুরু হয়। ১৯৯৫ সালে
নরসিমা রাও মন্ত্রী সভায় পুনরায় দেশের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। এর মধ্যে ১৯৮০
সাল থেকে রাজ্যসভায় কংগ্রেস দলের নেতার
দায়িত্ব পালন করতে আরম্ব করেন।
১৯৬৬ থেকে ২০০৪ সাল অবধি
প্রণব বাবু পাঁচবারই রাজ্য সভার মনোনীত সাংসদ হয়েছেন। মাঝে দুবার লোকসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেও জিততে পারেন নি, ফলে তাঁর বিপক্ষে একটা চালু কথা
ছিল প্রণব বাবু ভোটে জিততে পারেন না, পিছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতায় থাকেন। সেই
অপবাদ ঘোচাতে বাংলার রবিনহুড হিসাবে পরিচিত অধীর চৌধুরীর অবদান অনস্বীকার্য। শোনা যায়, প্রণববাবুর দাঁড়াবার ইচ্ছা না
থাকা সত্ত্বেও অধীর চৌধুরী সোনিয়া গান্ধীকে বলে জঙ্গিপুর কেন্দ্রে তাকে
দলের প্রতীকে প্রার্থী করে নিজের কেন্দ্রের মত পরিচর্যা করে প্রণব বাবুকেও জেতান,
২০০৯ তে ওই কেন্দ্রে জেতার পরে ২০১২ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবার পরে তার
পুত্র অভিভিত মুখার্জী জেতেন এবং ২০১৪ সালেও জেতার পরে ২০১৯ সালের নির্বাচনে ঐ
কেন্দ্র কংগ্রেসের হাতছাড়া হয়।
২০০৪ সালে জেতার পরে যোগ্যতা এবং পারদর্শিতা সব চাইতে বেশি থাকা সত্ত্বেও তাঁর নাম প্রধানমন্ত্রী হিসাবে বিবেচিত হয় না, মনমোহন সিং মন্ত্রী সভায় প্রথমে প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর পরে ২০০৬ সালে বিদেশমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করার দায়িত্ব পান। ২০০৯ সালে আবার পদোন্নতি করে তাকে পুনরায় দেশের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব অর্পন করা হয়। ২০১২ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবার আগে অবধি তিনি দেশের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে যান। পরে তাঁর স্থলাভিসিক্ত হন চিদাম্বরম । ২০১৭ সালের ২৫শে জুলাই তাঁর রাষ্ট্রপতি হিসাবে দায়িত্ব শেষ হয়। কারন পরবর্তী বিজেপি সরকার তাকে দ্বিতীয়বারের জন্য মনোনীত করে নি। ২০০৪ সালে লোকসভায় যাওয়ার পরে তিনি লোকসভায় দলের নেতার দায়িত্বও পালন করেন। উল্লেখ থাকে যে বর্তমানে তাঁর সুযোগ্য ভাবশিষ্য অধীর চৌধুরী লোকসভায় সেই দলীয় নেতার দায়িত্ব সাফ্যলের সাথে পালন করে চলেছেন।
প্রণব বাবু একাধারে
যেমন বিভিন্ন সরকারী গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সুনাম এবং
সাফ্যলের সাথে পালন করেছেন, ঠিক তেমনিই তিনি কংগ্রেস দলের রাজ্য ও জাতীয় পর্যায়ের
গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি জাতীয় স্তরে দলের কোর
কমিটির বিশেষ দায়িত্বশীল সদস্য ছিলেন। তাঁর পরামর্শকে দলে আলাদা
গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কংগ্রেস দলের পরিকল্পনা গ্রহণে তাঁর দায়িত্ব সব
চাইতে বেশী এবং গ্রহনীয় ছিল। তাঁকে দেশের রাজনীতির
“চানক্ষ্য” বলা হতো। বাস্তব ক্ষেত্রে সত্যিই তিনি “চাণক্য”ই ছিলেন।
প্রণব বাবুকে দেশের
প্রতিরক্ষা মন্ত্রী থাকা কালিন পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতির দায়িত্ব পালন
করতে হয়েছে। তাঁর সমইয়েই কংগ্রেস দল তৃণমূল কংগ্রেসের
সাথে জোট করে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। পরমাণু
চুক্তির বিরোধিতায় উই.পি.এ-১ সরকার ফেলে দেওয়ার জন্য সি.পি.এমের প্রকাশ করাতের
চক্রান্তের বিরোধিতাতে সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধীর অনুমতি সাপেক্ষ্যে প্রণব বাবু এই
রাজ্যের তরফে সাথে সাথে জাতীয় স্তরের তার অনুমোদনের ব্যবস্থা
করেন।
এই চুক্তি প্রণব বাবু যে ভাবে
করেছিলেন, তাতে রাজ্য কংগ্রেসের সংগঠক ও লড়াকু কর্মীদের কিছু আপত্তি ছিল। কারন
দলের কার্য্যালয়ে বসে বা রাজ্যস্তরে দলের মধ্যে কোন আলোচনা
না করেই ১লা মার্চ ২০০৯ সাল, জিন্দাল হাউসে বসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আর মুকুল
রায়কে নিয়ে বসে দলের তরফে তিনি জোট ঘোষনায় সাথে সাথে জোট
নেত্রী হিসাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামও ঘোষনা করে দেন। যে এক তরফা সিদ্ধান্ত
দলের বেশী অংশকে অসুখী করেছিল। তার ফল স্বরূপ তিনি প্রতিরক্ষা
মন্ত্রী তথা সভাপতি থাকা সত্ত্বেও বিধান ভবনে তাকে রাকেশ
সিংদের কাছে হেনস্থা হতে হয়েছিল। সেই পরবর্তীতে ২০১১ সালে নতুন সরকার গঠনের পরে এটাই
প্রমান হয়েছিল যে, কংগ্রেস দল এক তরফা জোট করে ক্ষতিগ্রস্থি হয়েছিল। পরে জোট থেকে
কংগ্রেসকে চলে আসতে বাধ্য করাই হয়েছিল।
আমি অন্য প্রসঙ্গে না
গিয়ে আমাদের বনগাঁতে প্রণব বাবুর যোগাযোগ সম্পর্কে
যেটুকু জানা আছে জানাতে চেষ্টা করব। আগেই বলেছি, প্রণব বাবু বনগাঁতে
ব্যক্তিগত পর্যায়ে খুব বেশী এসেছেন বলে জানা নেই, তবে ১৯৮২ সালে গোপালনগরে ভূপেন
শেঠের ভোটের জনসভা করতে এসেছিলেন। কলকাতা কপার হাউস থেকে
বনগাঁর ছাত্র নেতা, পরবর্তীতে যুব কংগ্রেসের সহ-সভাপতি আমার বন্ধু দেবু চ্যাটার্জী
সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন, যাওয়ার সময়ে প্রণব বাবুর গাড়ীতে
উঠে তাঁকে কলকাতার দিকে এগিয়ে দিতে গেছিলেন। সেই দিন ভূপেনদার সাথে
প্রণব বাবুর প্রথম সঠিক অর্থে পরিচিতি ঘটে। পরবর্তীতে যা আরো দৃঢ় ও মজবুত হয়।
এছাড়া, যে বার “টর্নেডো” হয়েছিল,
কলাশিম, ঠাকুরনগর অঞ্চলে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল, তখন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হিসাবে প্রণব বাবু কলাশিম, চাঁদপাড়া, ঠাকুরনগর
সরেজমিনে পরিদর্শনে এসেছিলেন এবং ঐ অঞ্চলে অনেকের সাথে কথা
বলেছিলেন। চাঁদপাড়া –ঠাকুরনগর অঞ্চলের দীঘাতে কংগ্রেস নেতা প্রয়াত রাধাপদ
বিশ্বাসের বাড়ীতে বসে ছিলেন এবং সব কিছুর খোজ খবর নিয়েছিলেন। ফেরার পথে চাঁদপাড়া
স্টেশনের পাশে ঢাকুড়িয়া ক্লাবেও কিছুক্ষন বসে ক্ষতিগ্রস্থ মানুষদের সাথে কথা
বার্তা বলে ছিলেন। এই সময় ওখানে ঐ অঞ্চলের কংগ্রেস নেতা শ্রী শান্তিময় চক্রবর্তীর
মত মানুষ উপস্থিত ছিলেন।
এছাড়া আমার জানা মতে ২০১২
সালে অর্থমন্ত্রী হিসাবে পেট্রাপোল বর্ডারে বাংলাদেশের সাথে আমদানি রপ্তানিএ
পরিকাঠামোর আধুনিকরনের জন্য বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী সাথে একত্রে উদ্ধোধন করতে
এসেছিলেন, সেটা হেলিকপ্টারেই যাতাযাত করেছিলেন।
আর একটা বিষয় উল্লেখ করা
উচিত মনে করেই জানাচ্ছি, ঘটনাটি যদিও বনগাঁর অনেক বাইরে এই জেলাতেও নয়, নদীয়াতে কিন্তু যেহেতু বনগাঁর মানুষ এর সাথে
জডিয়ে আছে,তাই লেখার চেষ্টা করছি। ২০০৪ সালে জঙ্গিপুর লোকসভা থেকে নির্বাচিত
হওয়ার পরে প্রণব বাবুকে নিয়মিত জঙ্গিপুর, তাঁর নির্বাচনি কেন্দ্রে যেতে
হতো। জেতার পরে জঙ্গিপুরে তাঁর একটা বাড়ীও তৈরী হয়েছিল।
দিল্লী থেকে কলকাতা হয়ে গাড়ীতে যাতায়াত করতে হতো। আমার বন্ধু
বনগাঁর মানুষ ডাঃ মৃনাল বিশ্বাস তখন নদীয়া জেলার মুখ্য জেলা স্বাস্থ্য আধিকারিক
হয়ে কৃষ্ণনগরে থাকেন। বিদেশমন্ত্রী হিসাবে জাতীয়
সড়কের বেথুয়াডহরিতে প্রণব বাবুর গাড়ীতে দুর্ঘটনা ঘটে এবং প্রণব বাবু ভীষণ আঘাতপ্রাপ্ত হন,
বিশেষ করে তাঁর মাথায় প্রচন্ড আঘাত লাগে এবং মাথার চামড়া অনেকটাই
ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। কাছাকাছি “নাকাশিপাড়া” ছোট প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র,
যেখানে কোন ভালো পরিকাঠামো নেই, কোন রকমে মানুষকে কিছু পরিষেবা দেওয়া যায়
মাত্র। কোন পথ, উপায় না পেয়ে প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য ওখানেই নিয়ে যাওয়া হয়। ভারপ্রাপ্ত ডাক্তার ছিলেন এবং দেখার পরে কি
করবেন বুঝতে না পেরে পরামর্শের জন্য নদীয়া জেলার মুখ্য জেলা স্বাস্থ্য আধিকারিক
হিসাবে ডাঃ মৃণাল বিশ্বাসকে ফোনে জানান। অবস্থার গুরুত্ব বিচার করে প্রণব বাবুকে কল্যাণী
বা কৃষ্ণনগরে নেওয়ার অবস্থা না থাকায় বাধ্য হয়ে দুই ডাক্তার মিলে বাধ্য হয়, ওখানে
কিছু করা অর্থাৎ প্রাথমিক চিকিৎসা হিসাবে রক্ত বন্ধ করার জন্য ব্যাবস্থা নিতে। ডা; মৃণাল বিশ্বাস
ওখানকার নিযুক্ত চিকিৎসক ডাঃ পলাশ মজুমদারকে, তাঁর করনীয় করার জন্য
বলেন এবং নিজেও কৃষ্ণনগর থেকে গিয়ে পৌঁছান। একটা ছোট
প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে সেদিন যেভাবে মাথার চামড়া পুর্নস্থাপন করা
হয়, সেটা চিন্তাও করা যায় না। তার উপর বিদেশমন্ত্রী বলে কথা। যাই হোক,
যতটা ভালো সম্ভব, তারা চেষ্টা করে রক্ত বন্ধ করেন। পরবর্তীতে প্রণব বাবুকে কলকাতায়
এবং তারও পরে দিল্লীতে চিকিৎসা করা হয়।
ইতিমধ্যে ডাঃ মৃণাল বিশ্বাসকে
সোমনাথ চ্যাটার্জী, সোনীয়া গান্ধী, রাজ্য স্বাস্থ্যমন্ত্রী
সূর্য্যকান্ত মিশ্র, প্রণব বাবুর পুত্র অভিজিত মুখার্জী
প্রত্যেকেই ফোন করে প্রণব বাবুর স্বাস্থ্য সম্পর্কে খোঁজ খবর নেন এবং
এদের কাজে প্রশংসা করেন। সুস্থ হওয়ার পরে প্রণববাবুও দুই একবার
ডাঃ মৃণাল বিশ্বাসকে ফোন করে তার প্রশংসাই করেছেন।
আমি ব্যাক্তিগতভাবে তিন
চার বার প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতির সাথে দলীয় কাজে এবং প্রাদেশিক সভাতে কথা বার্তা
বলেছি। একবার ঝগড়াও করেছি, সেটাও এক সুন্দর ঘটনা। জেলা কংগ্রেস সভাপতি শ্রী দেবী
ঘোষাল, ফোনে জানালেন প্রদেশ সভাপতি ব্লকস্তরেও কথা বলবেন, সেই জন্য
সকাল ১০টায় বিধান ভবনে পৌঁছাতে হবে। আমরা পৌঁছালাম, সাড়ে দশটা
নাগাদ প্রণববাবু এসেই সকলের কাছেই কিছু কিছু জানতে চাইলেন। আমাদের যার যা জানানোর
জানালাম। গাইঘাটার নারায়ণ, তার বক্তব্যতে দলের কিছু সমলোচনা করা প্রনববাবুর পছন্দ না হওযায় প্রণববাবু তাঁর বলার সময় নারায়ণের উদ্দ্যেশে “ন-চ্যাংড়া”
শব্দটি ব্যাবহার করে ফেলেন। সেটা আমাদের খারাপ লাগে এবং আমি বিশেষ করে একটু জোরে
জোরে অনেক কথা বলি। প্রণব বাবু বুঝতে পারেন, তাঁর বলাটা ঠিক হয় নি।
তিনি সভা ছেড়ে উপরে গিয়ে কিছুক্ষণ পরে ফিরে আসেন একজন
সুন্দর দেখতে মানুষকে সাথে নিয়ে। ওবার এসে কিন্তু উনি খুব ভালো ভালো কথা বলতে আরম্ব
করেন, বিশেষ নারায়ণকে কাছে ডেকে নিয়ে আলাদা কথা বলেন, আমারও প্রশংসা করেন। পরিবেশটা স্বাভাবিক
করতে সেই ভদ্রলোকের পরিচিতি করান সকলের সাথে। আমরা জানতে পারি তাঁর নাম শ্রী দেবী
পাল, আগে একবার দক্ষিন কলকাতা থেকে সাংসদ হয়েছেন। দল থেকে চলে গিয়েছেন আবার আসতে
চান, তাই সকাল আটটায় এসে অপেক্ষা করছেন ইত্যাদি ইত্যাদি। আমাদের কিছু টিফিনের ব্যাবস্থাও
করলেন, একবার বনগাঁর দিকেও আসবেন জানালেন। আমরা চলে এলাম।
রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরে
কলকাতায় এলে তাঁকে দলীয়ভাবে সন্মান
জ্ঞাপনের জন্য সেদিন থাকার জন্য আমাকে অধীর চৌধুরী অনুরোধ করলেও আমার পক্ষে বনগাঁয় ফেরায় অনেক অসুবিধার
জন্য থাকতে পারি নি। ব্যক্তিগত স্তরে আমার সাথে খুব বেশী
কথা কোন দিনই হয়নি, তবে আমাকে চিনতেন খুব ভালো ভাবেই। সেটা জোরে কথা বলা, আর সামনা
সামনি সত্যি কথা নিষ্ঠুর হলেও বলে ফেলতে পারি,সেজন্যও বটে।
আনন্দবাজারেই রাজ্যের
মুখ্যমন্ত্রী লিখছেন দেখলাম যে, দেবী চট্ট্যোপাধ্যায়কে সরিয়ে মমতা
বন্দ্যোপাধ্যায়কে দলের প্রার্থী করার জন্য প্রণববাবুই নাকি
রাজীব গান্ধীর কাছে দরবার করে করিয়েছিলেন। সেই জন্যই তো প্রনব বাবু যখন রাস্ট্রপতি
পদের প্রার্থী ঘোষিত হয়েছেন, সেজন্যই বামফন্ট্র হঠাতে দলের পক্ষে
জোট করে জোট নেত্রী ঘোষণা করে যাকে ক্ষমতায়
এনেছিলেন, সেই তিনিই প্রকাশ্য রাজপথে মুখ্যমন্ত্রী হয়েও মিছিল করে “WE
WANT ABDUL KALAM AGAIN’ বলতে দ্বিধা করেন
নি, আবার নির্বাচিত হওয়ার পরে শপথ গ্রহণ
অনুষ্ঠানের মধ্যেই দাদা রাষ্ট্রপতি হিসাবে কলকা্তাতেই আপনাকে প্রথম আসতে হবে কিন্তু বলতেও দ্বিধা করেন
নি।
প্রণব বাবুর কথা বলতে
গিয়ে তাঁর ছেলেকে বাদ দেওয়া বোধ হয় ঠিক হবে না। বনগাঁ লোকসভা উপ
নির্বাচনে আমাদের প্রার্থী কুন্তলের হয়ে রোড়শো করতে ডেকেছিলাম, এসেও ছিলেন।
আমাদের আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ, তাই রোড়শোতে একটা ৪০৭ গাড়ীর ব্যবস্থা করতে পেরেছিলাম।
সকাল ১০টার বেলে থেকে নিজের গাড়ী ফেরৎ পাঠিয়ে আমাদের ঐ ছোট গাড়ীতে দাঁড়িয়ে ঘুরতে ঘুরতে
বেলা ৫ টায় বনগাঁ পার্টি অফিসে আধ ঘণ্টার জন্য দাঁড়িয়ে আমার বেড়িয়ে স্বরূপনগরে শেষ করে রাত
দশটায় চোংদাতে তার গাড়ীতে ছেড়ে দিয়েছিলাম। অত্যন্ত
অমায়িক ব্যবহার সংযত আচরণ, কম কথা বলা মানুষ। আমার
খুব ভালো লেগেছিল, পরেও অনেকবার কথা বলেছি কথা বলতে গিয়ে কখনও বিরক্ত মনে হয়
নি।
প্রণব বাবুর সম্পর্কে অনেক কিছু লেখা যায়, একটা লোক জীবনে এত কিছু করতে পারেন ভাবাই যায় না। পদ্মবিভূষণ, ভারতরত্ন, বিভিন্ন দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী এবং তার প্রত্যেকটিতেই সফল, এটি যার তার দ্বারা সম্ভব নয়।
তাঁর প্রয়াণ দেশের,
পৃথিবীর, মানব সমাজের, আমাদের দেশ এবং রাজ্যের সাথে আমাদের বাঙ্গালীদের এক বিশাল
ক্ষতি সাধন করল। তার শুন্যতা পূরন করা অসম্ভব। তার আদর্শ, তার প্রতিভা, তার
ভাবাবেগ এবং কর্মনিষ্ঠাকে জানাই নত মস্তকে আমার সশ্রদ্ধ
প্রনাম। তার পরিবারের প্রতি জানাই আমার আন্তরিক সমবেদনা।
উনি যেখানেই থাকুন ভালো
থাকুন। তার অমর আত্মার শান্তি কামনা করি।
কৃষ্ণপদ চন্দ
বনগাঁ, ১লা সেপ্টেম্বর ২০২০